প্রত্যয় গুপ্ত, প্রাক্তনী

এখানে মেঘ গাভীর মতো না চড়লেও, বৃষ্টি যেন এখন সত্যি সত্যিই বারোমাস জুড়ে পরে। আমাদের সেই ছোট্টবেলাটা অথবা যখন সদ্য বিকশিত মনকুসুম পেখম মেলবার অপেক্ষায়, সেই সময়টায় আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনা খানিকটা অন্যরকম ছিল। আমরা জানতাম, ঠিক কখন বর্ষা আসবে। ঠিক কখন টিপটপ গলিতে হাতে জুতো নিয়ে, প্যান্টটা হাঁটু অবধি গুটিয়ে কার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। অথবা, স্কুলের মাঠে পুজোর জন্যে লাগানো বাঁশে ঠিক কতটা উঠে ক্লাস সিক্সের ছেলেটা আবার নীচে নেমে আসবে, এসবই আমরা জানতাম, চিনতাম।
এমনই এক খুব চেনা বিকেল বেলা, জয়েন্টের অঙ্ক ক্লাস শেষ করে হন্তদন্ত হয়ে ফিরছিলাম আমরা পাঁচজন। পাঁচজন মানে আমি, সৌরভ, সমান্ত, প্রকর্ষ এবং অমিতাভ। আমাদের গন্তব্য ছিল মতিঝিল কলেজমাঠ। ইতিহাস প্রসিদ্ধ না হলেও, দমদমের বুকে যাদের দ্বৈরথ এবং বন্ধুত্ব দুটোই সমানতালে এগিয়ে চলে, সেই দুই চির-প্রতিদ্বন্দ্বী স্কুল, কে কে হিন্দু আর কিশোর ভারতীর ফুটবল ম্যাচ অপেক্ষা করে ছিলো আমাদের জন্য।

আকাশে কালো মেঘ মাঝেমধ্যেই নিজের সদম্ভ উপস্থিতি জানান দিচ্ছিলো প্রবল বিক্রমে, সাথে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি যেন বহুকালের জমে থাকা ক্ষততে স্নেহের প্রলেপ। সেই আলোআঁধারির বিকেলে মাঠজুড়ে ছড়িয়ে পরলো আমাদের শৈশবেরা। সময় বয়ে চলেছিল নিজের নিয়মে, সাথে কাঁদামাঠে ফুটবলের যে নিয়ম - অফুরন্ত গোলমিস, অনিয়ন্ত্রিত ট্যাকল, কারোর পায়ে চোট, কারোর মাথা গরম, খানিক হাতাহাতি, খানিক না লিখতে পারা নিষিদ্ধ শব্দের অবিরাম ফুলঝুড়ি। এভাবেই, পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনার মতো অমিয়র গোল। প্রত্যাশিত (অথবা অপ্রত্যাশিত) আমাদের এগিয়ে যাওয়া, স্বাভাবিকভাবেই চাগিয়ে দেয় মনোবল। এরকম সময়ে যারা প্রকর্ষকে দেখেছে তারা জানে, যুবভারতী না হলেও মোটামুটি কল্যাণী বা বারাসত স্টেডিয়ামের সমবেত জনতার সম্মিলিত চিৎকার, একাই করে দেওয়ার ক্ষমতা ওর আছে। সেই এগিয়ে যাওয়ার মনোবলকে সঙ্গে করেই এবারে চলে এলো পরপর দুটি গোল, দুটোই কৌশিকের পায়ে ভর করে। এই গোলদুটির প্রথমটি প্রায় মাঝমাঠ থেকে অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় করা একটি দর্শনীয় গোল, যাকে বিশ্বমানের না বলা গেলেও, পৌনে বিশ্বমানের বলাই চলে নির্দ্বিধায়, দ্বিতীয়টি পেনাল্টি বক্সের বাইরে থেকে মারা অতর্কিত বা পায়ের শটে জাল কাঁপিয়ে দেওয়া অসাধারণ গোল। তিন গোল করে আরেকটি জিত নিশ্চিত করে সকলেই তখন বাঁধনছাড়া উচ্ছাসে মেতে উঠেছে।
খেলা আমাদের জীবনের প্রতিচ্ছবি, একথা হামেশাই শোনা যায়, জীবন কীভাবে কোন বাঁকে বেঁকে যাবে শুধু সময়ই বলতে পারে তার কথা। সময় বলেও, যেভাবে বললো এইবারে। তিন গোলে এগিয়ে থাকা ম্যাচে বহুগুণ দক্ষতায়, আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দল শুধু সবকটি গোল শোধ করলো তাই নয়, চার নম্বর গোলটি দিয়ে এক গোলে লিডও নিয়ে নিলো।

দিনের আলো নিভে আসছে, কালো মেঘ আরও কালো হতে হতে কখন যে সন্ধ্যেকে ডেকে আনলো কেউ টেরই পাইনি। সন্ধ্যে ছটা বাজতে দু মিনিট বাকি। একটু পরেই খেলা শেষ। এগিয়ে থাকার আনন্দে যারা অকাল উৎসবে মেতে উঠেছিল, সময়ের নিয়মে তারা এখন হারছে। আমাদের সকলের মনখারাপের পথ ধরেই শেষ গোলকিকে অমিয়র ছোট্ট ক্রস পেয়েছিল রূপক। আমরা যখন ভাগ্য ও পরাজয় দুটোই মেনে নিয়েছিলাম, বল পায়ে রূপক হটাৎ দুঃসাহসিক চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসেছিল সময়কে। এক মুহুর্ত সময় যেন থমকে থেমে গেছিল ওর পায়ে। দূর থেকে সেই অবিশ্বাস্য শটে গোল করে হারা ম্যাচ ড্র করেছিল রূপক, সাথে আমাদের টিম।
আমরা সেই ম্যাচ জিতিনি, ড্র করেছি। সব লড়াই, সেটা মাঠে হোক বা মাঠের বাইরে, জেতাও যায়না। তাই আমরা হারতেও জানি। কিন্তু সেদিনের পর থেকে যে জিনিসটা আরও বেশি করে জানি, যতই হতাশা ঘিরে ধরুক, পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যাক, আমরা যদি শেষ মুহূর্ত অবধি ময়দান না ছাড়ি, ঠিক আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে লুকিয়ে থাকা রূপকেরা আমাদের লড়াইয়ে টিকিয়ে রাখবেই। আর অবিশ্বাস্য শটে গোল করে বারবার বলবে: "পিকচার আভি বাকি হ্যায়, মেরে দোস্ত"......
প্রাক্তনী, উচ্চমাধ্যমিক, ২০১২
লেখাটি কেমন লাগলো আপনার ? অবশ্যই Comment-এ জানানোর অনুরোধ রইল।
0 Comments
Post a Comment