খুব ছোটবেলার কথা আমার বিলক্ষণ মনে আছে। অভাব আর দারিদ্র আমার কপালে যেন চিরচিহ্ন দিয়ে গেছে। বাবা ছিলেন জনমজুর। পরের জমিতে হালবাওয়া ছিল দিন গুজরানের উপায়। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর বাবা যখন ঘরে ফিরতেন তখন তাঁকে খুবই ধ্বস্ত লাগত। কিন্তু সন্ধ্যেবেলায় ঘরে ফিরে চান করে হ্যারিকেনের আলোর কাছে আমাদের চার ভাইয়ের পড়ার পাশে চুপে বসে পড়তেন। মনযোগ দিয়ে আমরা পড়ছি কিনা শুধু সেই দিকেই ছিল বাবার লক্ষ্য। খালি পায়ে আমরা স্কুলে যেতাম। ইউনিফর্ম বলে কিছু ছিলনা। স্কুলে যাওয়ার জামাটি ছাড়া আর একটিমাত্র জামাই আমার ছিল। পূজোর সময় ঐ একসেট জামাপ্যান্টই বরাদ্দ ছিল আমাদের। সারা বছর ঐ দিয়েই চালাতে হবে -এটাই ছিল দস্তুরি। পরতে পরতে সে জামা ঘামে আর ঘষায় ঘষায় কাঁধের কাছে পিঠের দিকে ফেঁসে যেত। অনেকটা একালের ফ্যাসনদূরস্ত ছেঁড়া জিনসের মত। পাড়ার বৌদি-পিসীমণি-মামণিরা বলত -- ও টুবি তোর জামাখান ত মশারির জাল হয়ে গেলা রে। লজ্জা লাগত আমার খুব। ফ্যান ফ্যাল করে অসহায়ের মত লাজুক মুখে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আমার আর কোন রাস্তা ছিল না। এক প্রতিবেশী দিদি ছিল আমার মায়ের মত। কি করুণা হত তখন আমার উপর জানিনা। একবাটি দুধে ভেজানো রুটি সামনে ধরে বলত -- নে টুবি খা। দুঃখ-কষ্ট তখন সব যেন উবে যেত।

সেবার খুব ঠান্ডা পড়েছে। গরম জামাকাপড় তো আর নেই। কষ্টে-সৃষ্টে বাবা হাট থেকে একখানা সূতির চাদর কিনে আনলেন। একখানা চাদরে কিভাবে শীতে ম্যানেজ করা যায় তা বাবার থেকে শিখেছিলাম। ঢালা বিছানায় পাশাপাশি চারজন শুলে পরে বাবা চাদরটা সবার গায়ের ওপর দিয়ে টানা বিছিয়ে দিতেন। দিনের বেলায় মাঠে বাবার খাবার বেঁধে নিয়ে যাবার জন্যেও চাদরটা বেশ কাজে লাগত। বর্ষাকালে নালার স্রোতে দুজনে আড়াআড়ি ধরে চূণো মাছ ধরতেও চাদরখানার জুড়ি মেলা ভার। ঘরেতে যখন পড়তাম মাটির নিকোনো মেঝের উপরে চাদর পেতে আমরা চারভাই হ্যারিকেন বা কূপীর আলোতে পড়া করতাম। বাইরে বেরোতে হলে পড়ায় খামতি দিয়ে বইখাতা তুলে চাদরটা উঠিয়ে তাই গায়ে জড়িয়ে শীতে বাইরে যেতাম। একদিন হয়েছে কি গভীর শীতে দু'ভাইয়ের একসঙ্গে ছোট বাথরুম পেয়েছে। চাদর জড়িয়ে কে আগে বাইরে যাবে তাই নিয়ে ধুন্ধুমার। হাতাহাতি হওয়ার উপক্রম। তখন আমার পায়ে লেগে হারিকেন গেছে উল্টে। তেল গড়িয়ে পড়ে গেছে সারা চাদরে। ধোঁয়া-অন্ধকারের মধ্যে বাবা চুপ করে কান্ডকারখানা দেখেছিলেন। হতাশ হয়ে বললেন দিলি তো সব শেষ করে। কত কষ্টের চাদরখানা। রেগে কাঁই হয়ে যাওয়া মা রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে নিভে যাওয়া হ্যারিকেনটাকে সরিয়ে ফেলে দু'হাতে চাদরের প্রান্তদেশ ধরে এমন ঝাড়া দিলেন যে বইখাতা পেন্সিল সব ছত্রখান হয়ে মাটি-মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। তারপর চাদরটাকে বাঁ হাতে ধরে ঝটকা দিয়ে মেঝের এককোণে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন।
পরের দিন সকালে রাগ পড়ে গেলে মা চাদরটাকে ধুয়ে উঠোনে রোদ্দুরে দড়িতে মেলে দিলেন।আমি দেখলাম চাদরের ঝালরগুলো বেয়ে জল পড়ছে টপ টপ করে। করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ঐদিকে। মনে হল চাদরটার চোখ বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে।
প্রাক্তনী
লেখাটি কেমন লাগলো আপনার ? অবশ্যই Comment-এ জানানোর অনুরোধ রইল।
0 Comments
Post a Comment