
একে জন্মান্তর ছাড়া আর কী বলা যায়! ছিলেন বিপ্লবী, হয়ে গেলেন ঋষি! ছিলেন ভাববাদী চিন্তাবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, কবি, সাহিত্যসেবক ও সশস্ত্র বিপ্লবী—উন্নীত হলেন অতিমানসের স্তরে, এক আধ্যাত্মিক সাধক ও দার্শনিক। আলিপুর বোমা মামলায় জেলবন্দি হলেন, কিন্তু জেল থেকে যখন বের হলেন, তখন তিনি একেবারেই অন্য মানুষ। বিপ্লবের কথা আর বলছেন না, বলছেন আধ্যাত্মিক কথা।
একদিন শুনলেন অন্তরের ডাক এবং নিলেন সেই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত—পণ্ডিচেরী যাওয়ার। আসলে, ঈশ্বর তাঁকে বাঁধাধরা সংসারের আবর্তে হারিয়ে যাওয়ার জন্য এই পৃথিবীতে পাঠাননি। দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচনের গুরুদায়িত্ব পালন করা ছিল তাঁর ঈশ্বর-নির্দেশিত কর্তব্য। তাই তো ১৮৯০ সালে আই.সি.এস. পরীক্ষায় একাদশ স্থান অধিকার করা সত্ত্বেও তাঁর সিভিল সার্ভিসে যোগ দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি শুধুমাত্র ঘোড়ায় চড়ার পরীক্ষায় অনুপস্থিত থাকার কারণে। যদিও তখনকার দিনে ঘোড়ায় চড়া শিখে নিলেও সিভিল সার্ভিস পদে নিযুক্ত হওয়ার নিয়ম ছিল।
অন্যদিকে, কারাবন্দি অবস্থায় তাঁর অপরিমেয় আধ্যাত্মিক উপলব্ধিও ছিল ঈশ্বর-নির্দিষ্ট। তাই বলা যায়, রাজনৈতিক জীবন ত্যাগ করে পণ্ডিচেরীতে তাঁর সনাতন ধর্ম প্রচার ও আশ্রম প্রতিষ্ঠার কাজে আত্মনিয়োগ করাও ছিল ঈশ্বর-নির্ধারিত। তাই তো স্বনামধন্য মাতামহ ঋষি রাজনারায়ণ বসুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাঁরই দৌহিত্র, সশস্ত্র বিপ্লবী অরবিন্দ রূপান্তরিত হলেন ঋষি অরবিন্দে।
পুণ্যভূমি ভারতে যুগে যুগে সাধক , মহাপুরুষ , বিভিন্ন ক্রান্তিকারী জন্মগ্রহণ করেছেন । তাঁদের মধ্যে শ্রীঅরবিন্দ ঘোষ একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র । বাবা ডঃ কৃষ্ণধন ঘোষ উচ্চতর শিক্ষার জন্য স্ত্রীও দুই পুত্রকে নিয়ে ইংল্যান্ডে যান এবং ভারতীয় সমাজের রক্ষণশীলতা , সংস্কার , অভ্যাস , রীতিনীতি ত্যাগ করে হয়ে উঠেছিলেন একেবারে সাহেবী কায়দার মানুষ । ১৮৭১ সালে এম . ডি . করে দেশে ফিরে আসেন । অবশ্য তাঁর এই উগ্র সাহেবিয়ানার মোহভঙ্গ ঘটেছিল একেবারে জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে । দেশে ফেরার বছরখানেক পরে --- ১৮৭২ -এর ১৫ আগষ্ট জন্মগ্রহণ করেন অরবিন্দ । মা স্বর্ণলতাদেবীও কবিতা লেখা ও নানান সামাজিক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন । ডঃ কৃষ্ণধন ঘোষ চেয়েছিলেন ছেলেমেয়েদের ইংরাজি ভাষায় ও আদব-কায়দায় পারদর্শী করে তুলতে । তাই পাঁচ বছর বয়সে দার্জিলিংয়ের লরেটো স্কুলে অরবিন্দের লেখাপড়া শুরু হয় কিন্তু একসময় বাবা ডাঃ কৃষ্ণধনের কাছে স্কুলের শিক্ষা ও পরিবেশ যথেষ্ট মনে না হওয়ায় ফের সপরিবারে তিনি বিলেতে চলে যান । বিলেত থেকে ফিরে আসার পর অরবিন্দকে বাংলা শেখাতেন দীনেন্দ্রকুমার রায় । তিনি তাঁর ছাত্র অরবিন্দ সম্বন্ধে লিখেছেন --- ' আবাল্য ইংল্যান্ড প্রবাসী মেধাবী অরবিন্দের বিলাতি সমাজের ব্যসন ও বিলাসিতা, চাকচিক্য , আদব কায়দা , খাদ্য , পোশাক ও বিচিত্র মোহ তাঁর মনুষ্যত্ব-মণ্ডিত উদার হৃদয় স্পর্শ পর্যন্ত করতে পারেনি । ইউরোপের নানান ভাষায় তিনি ছিলেন সুপণ্ডিত অথচ বাঙালির মতো তিনি বাংলা কথা বলতে পারেন না বা মাতৃভাষায় চিঠি লিখতে পারেন না , এগুলিকে তিনি অমার্জনীয় ত্রুটি বলে মনে করতেন । ….. মাতৃভাষায় কথা বলবার জন্য তাঁর কী প্রগাঢ় ব্যাকুলতা ! .... দিনরাত একত্রে অনেকটা সময় কাটিয়ে যতই তাঁর হৃদয়ের পরিচয় পেতে লাগলাম ততই বুঝতে পারলাম , অরবিন্দ এই পৃথিবীর মানুষ নন , তিনি শাপভ্রষ্ট দেবতা । ভগবান কি ভেবে তাঁকে বাঙালি করে অভিশপ্ত ভারতে নির্বাসিত করেছিলেন তা তিনিই বলতে পারবেন ' । ১৯০৬ সালের আগস্ট মাসে বরোদা রাজ সরকারের ৭৫০ টাকা বেতনের চাকরি ছেড়ে দিয়ে দেশের কাজে ব্রতী হতে অরবিন্দ কলকাতায় জাতীয় শিক্ষা পরিষদ প্রতিষ্ঠিত ' ন্যাশনাল কলেজের অধ্যক্ষ পদে যোগ দিয়েছিলেন । এই সময়েই রাজা সুবোধ মল্লিকের অনুরোধে তিনি ' বন্দেমাতরম ' ইংরেজি পত্রিকা ( প্রথমে দৈনিক , পরে সাপ্তাহিক ) সম্পাদনার কাজ শুরু করেন । এই ' বন্দেমাতরম ' পত্রিকায় এক-একটি অগ্নিবর্ষী লেখায় জাতির ধমনীতে যেন নতুন রক্তপ্রবাহ শুরু করে । তবে ১৯০২ সালে বরোদায় থাকাকালীন সময়ে নিবেদিতার সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয় । অরবিন্দ লিখেছেন --- ঐসময় তিনি নিবেদিতার ' কালী দি মাদার ' বইটি পড়ে মোহিত হয়েছিলেন । তিনি তখন বাংলার বৈপ্লবিক কাজে লিপ্ত হননি , মানসিক প্রস্তুতি চলছে , তখনি তাঁর কাছে এই বইটি পৌঁছায় এবং তিনি অত্যন্ত উদ্দীপনা বোধ করেন । স্বদেশী যুগে বাংলার মুখ্য বিপ্লবী নেতারূপে পরিচিত অরবিন্দ এই বইটির প্রভাবের কথা স্বীকার করেছেন । বরোদা-পরবর্তিকালে তাঁদের দুজনের দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে একাধিকবার । এমনকি বাগবাজারে নিবেদিতার বাসভবনে অরবিন্দ আসতেন । অরবিন্দের যে যোগের প্রতি আকর্ষণ ও নিষ্ঠা তাও স্বামী বিবেকানন্দের ' রাজযোগ পড়ে যা তিনি পেয়েছিলেন নিবেদিতার কাছ থেকে । অরবিন্দ ও নিবেদিতা দুজনেই বিশ্বাস করতেন , রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের আদর্শ অনুসরণ করেই ভারতের সার্বিক জাগরণ ও মুক্তি আসবে এবং ভারত তার মহিমায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে । শঙ্করীপ্রসাদ বসু লিখেছেন --- " ...... অরবিন্দ অনেকবারই রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের প্রতি চূড়ান্ত শ্রদ্ধা ও ভক্তি প্রকাশ করেছেন ; ওঁরাই যে জাতীয় জীবনের মূল প্রেরণা-উৎস তা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন , অনুভব করেছেন , স্বদেশী আন্দোলনের পিছনে ছিল ' রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের শক্তি ' । অরবিন্দ ও নিবেদিতা একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এবং কোন অবস্থাতেই তাঁদের সম্পর্কে চিড় ধরেনি । নিবেদিতা অরবিন্দের প্রতি সাহায্যের হাত সবসময় বাড়িয়ে রেখেছিলেন । মনে করেছিলেন , তাঁর নিজের উদ্দেশ্য ও অরবিন্দের উদ্দেশ্য অভিন্ন --- ভারতের স্বাধীনতা যে করেই হোক অর্জন করা ।

রোমান ক্যাথলিক সন্ন্যাসী ও বৈদান্তিক তেজস্বী ত্যাগী দেশপ্রেমিক ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় ' সন্ধ্যা ' কাগজে অরবিন্দকে প্রথম আবাহন করেছিলেন ' মানস সরোবরে অরবিন্দ ' প্রবন্ধে । এই প্রবন্ধটি লেখার বছরখানেক পরে রাজদ্রোহ প্রচারের অভিযোগে কারাগারে বন্দি অবস্থায় ব্রহ্মবান্ধবের মৃত্যু ঘটে । এই প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন --- ' অমল-শুভ্র অরবিন্দ দেখিয়াছ কি ? তিনি ভারতমানস-সরোবরের প্রস্ফুটিত শতদল ! আমাদের এই অরবিন্দ জগৎদুর্লভ । হিমশুভ্র বর্ণে সাত্ত্বিকতার দিব্য শ্রী ! বৃহৎ ও মহৎ । হৃদয়ের প্রসারতায় বৃহৎ ! হিন্দুর স্বধর্ম মহিমায় মহৎ ! এমন একটা গোটা ও খাঁটি মানুষ ---- এমন বজ্রের মতো বহ্নিগর্ভ আবার কমল পর্ণের মতো কান্তপেলব , এহেন জ্ঞানাঢ্য , এমন ধ্যান-সমাহিত মানুষ তোমরা ত্রিভুবনে খুঁজে পাবে না । তিনি ফিরিঙ্গীর আঁস্তাকুড়ের বাবু ছিলেন না । দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচনের জন্য ইহলোকের সুখ সাধ বিসর্জন দিয়ে খাঁটি মায়ের ছেলে অরবিন্দ ' বন্দেমাতরম ' পত্রিকার সম্পাদনায় ব্রতী হয়েছেন । তিনি সত্য সত্যই হয়ে উঠেছিলেন ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের " ভবানন্দ , জীবানন্দ , ধীরানন্দ স্বামী " । খুব কাছ থেকে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন অরবিন্দের রাজনীতি-প্রাঙ্গনে সবেমাত্র পদার্পণের মুহূর্তটি --- তারই মাঝে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন অরবিন্দের বিপ্লবী সত্তা ছাপিয়ে তাঁর ' ধ্যান-সমাহিত মানুষটিকে ' ।
সিভিল সার্ভিসে যোগ না দিয়ে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে স্বদেশী আন্দোলনের নেপথ্য নায়ক হিসাবে তিনি আত্মপ্রকাশ করেছিলেন । বয়স ও রাজনীতিতে অভিজ্ঞতার নিরিখে বিপিন চন্দ্র পাল ছিলেন অনেক প্রবীণ । তা সত্ত্বেও অরবিন্দের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে ' বিধাতার চিহ্নিত পুরুষ ' রূপে মেনে নিতে তিনিও কুন্ঠিত হননি । কেন্দ্রীয় পুরুষ ও সর্বাধিনায়ক হিসাবে শ্রীঅরবিন্দের যোগ্য হাতে ' বন্দেমাতরম ' পত্রিকাটি সেইসময় একেবারে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিল । দ্রুত ও অনায়াসে তিনি লিখে ফেলতেন স্বদেশবাসীর ঘুম ভাঙানিয়া কালজয়ী সেই সব নিবন্ধগুলি । শুধু কলকাতা নয় , সারা দেশের শিক্ষিত সম্প্রদায় সে-যুগের উদ্দীপনাপূর্ণ সমস্যাগুলি সম্বন্ধে অতুলনীয় এই মহামানবের বজ্রকঠোর মতামতের পথ চেয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকত । দিনের বেলা করতেন আচার্যের পদে চাকরি আর রাতের বেলা চলত সশস্ত্র আন্দোলনের পরিকল্পনা ও ট্রেনিং । এই সময় দুই সেরা বাঙালি মনীষী ( সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র ও স্বামী বিবেকানন্দ ) তাঁকে বিশেষ ভাবে প্রভাবিত করেছিলেন । স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন তাঁর কাছে আত্মনির্ভরশীলতার আদর্শ । " আনন্দমঠ " উপন্যাসে সন্ন্যাসীদের আত্মত্যাগের আদর্শ , তাঁদের সংগ্রামের প্রতি নিষ্ঠা ও সততা তাঁকে মুগ্ধ করেছিল । নিজেকে তিনি ওই সন্ন্যাসীদের একজন বলে ভাবতে শুরু করেছিলেন । আপোষের রাজনীতিতে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না । শক্ত হাতে রক্ত ছিটিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করতেই তিনি বেশি পছন্দ করতেন । বিজাতীয়-সংস্কৃতি থেকে দেশকে মুক্ত করে ও দেশের প্রাচীন ঐতিহ্য-সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করে স্বার্থপরতা , ভীরুতা , পরনির্ভরশীলতা ও ভাবাবেগ মুক্ত স্বাধীন দেশ গড়তে চেয়েছিলেন তিনি । তাঁর এক-একটি আগুন ঝরানো লেখায় জাতির ধমনীতে নতুন রক্ত একেবারে টগবগিয়ে উঠত । এর ভিতর দিয়েই তিনি কয়েক-শত ছাত্রের আচার্য পদ থেকে পৌঁছে গিয়েছিলেন সমস্ত জাতির আচার্য পদে । এমনকি গতানুগতিক আত্মতৃপ্ত বৃটিশ সাংবাদিকদের মনেও তা গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল । ' বন্দেমাতরম ' পত্রিকা থেকে সপ্তাহের পর সপ্তাহ যাবৎ উদ্ধৃতি ছাপা হয়েছিল লণ্ডনের The Times পত্রিকার স্তম্ভে । এরপর দ্রুতগতিতে দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন শুরু হয়ে গিয়েছিল । ' স্বরাজ ' - ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মথিত করে রাজপথে বেরিয়ে পড়েছিল স্কুল-কলেজের ছাত্ররা । কোথাও চলছে বিদেশি পণ্যদ্রব্য বর্জনের জন্য পিকেটিং আবার কোথাও চলছে নেতাদের অগ্নিবর্ষী বক্তৃতা , তার উপর সংবাদপত্রগুলিতে বিশেষ করে ' যুগান্তর ' ও ' বন্দেমাতরম ' কাগজে তরুণদের উদ্দেশ্যে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল জ্বালাময়ী সশস্ত্র সংগ্রামের আহ্বান ---- চারদিকে শুধুই বৃটিশ বিরোধী আবহ । শ্রীঅরবিন্দ সবসময় " জননী জন্মভুমিশ্চ স্বর্গাদপী গরীয়সী " এই চিন্তাধারা , এই মনোভাব নিয়ে এগিয়ে চলতেন । বিপ্লবী সন্ন্যাসী ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় লিখেছেন --- ' বিলেতে লেখাপড়া শিখলেও বিলিতি অবিদ্যার পূতনা-মায়া অরবিন্দকে মুগ্ধ করতে পারেনি । অরবিন্দ শরতের সদ্য প্রস্ফুটিত পদ্মের মতো নিজের দেশের স্বধর্ম ও সভ্যতার মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে জননী-জন্মভূমির শ্রীচরণপদ্মে শ্রদ্ধার্ঘ্যের মত শোভা পাচ্ছে । অরবিন্দ ফিরিঙ্গীর আঁস্তাকুড়ের বাবু নন ' । খাঁটি মায়ের ছেলে হয়ে তিনি ' ভবানীমন্দির ' ইংরাজি প্রবন্ধ-পুস্তিকার প্রকাশনা শুরু করেছিলেন । রাজদ্রোহিতার অভিযোগে " বন্দেমাতরম " পত্রিকাটিকে বন্ধ করে দেওয়া হয় । ১৯০৮ সালের মাঝরাতে কলকাতার গ্রে স্ট্রিটের বাড়ি থেকে বৈপ্লবিক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকা ও বে-আইনিভাবে বোমা তৈরির অভিযোগে শ্রীঅরবিন্দকে কারারুদ্ধ করা হয় । বাড়িতে একটি মাটির ভাঁড়ে দক্ষিণেশ্বর থেকে কিছু মাটি সংগ্রহ করে রাখা ছিল এবং পুলিশ উল্লসিত হয়েছিল সেই ভাঁড়ের মাটি বোমা তৈরির উপকরণ মনে করে । অনিশ্চয়তার অন্ধকারে মৃত্যুর মুখোমুখি শ্রীঅরবিন্দ । স্ত্রী মৃণালিনী দেবী সে সময় প্রিয় বান্ধবী সুধীরা বসুর সঙ্গে বাগবাজারে মা সারদার কাছে । সব শুনে মা সারদা বলেছিলেন , ' তোমার স্বামী ভগবানের পূর্ণ আশ্রিত পুরুষ । ঠাকুরের আশীর্বাদে তিনি অতি সত্বর নিষ্পাপ প্রমাণে মুক্ত হয়ে আসবেন , তবে তিনি সংসার করবেন না , ক্ষুদ্র আমিত্বের সংসার তাঁর জন্য নয় ' ।
আলিপুর বোমা মামলার বিচারাধীন বন্দী হিসেবে অরবিন্দকে প্রেসিডেন্সি জেলের নির্জন কারাকক্ষে কাটাতে হয়েছিল প্রায় এক বছর । কারাপ্রাচীরের ভেতরে শ্রীঅরবিন্দ ধ্যান ও যোগ সাধনায় নিবিষ্ট থাকতেন ঘন্টার পর ঘন্টা । প্রতিদিন মাথা মেঝেতে , পা শূন্যে সোজা উপরে রেখে কাটিয়ে দিতেন অনেকটা সময় । এই অবস্থায় তাঁর মধ্যে এক দিব্যচেতনার সঞ্চার হয় । তিনি ভাবছেন --- ' ভগবান তুমি তো জানো , আমার দেশ , আমার দেশের মানুষ , তাদের আমি এত ভালোবাসি , তাদেরই কল্যাণে আমি তোমার কাছে সমর্পিত , তবে হঠাৎ কেন এই কারাগার ? এই ভয়ঙ্কর নির্জনতা ? চোখের সামনে আকাশ নেই , দৃশ্য নেই , রয়েছে শুধুই নির্জীব সাদা বোবা পাথরের দেওয়াল আর নিঃসঙ্গ নির্জন এক অতল নীরবতা । শুনেছি এই নীরবতা যে সহ্য করতে পারে সে হয় দেবতা না হয় পশু । আমি কি পাগল হয়ে যাব ' ?
কারাগারের মধ্যে জন্ম নিয়েছিলেন ভগবান বাসুদেব আর এই কারাগারেই শ্রীঅরবিন্দ পেয়েছিলেন সেই বাসুদেবের দর্শন --- নিজের সমগ্র সত্তায় তিনি তা উপলব্ধি করেছিলেন । এরপর কারাগারটাই হয়ে উঠেছিল তাঁর কাছে " আশ্রম " । শ্রীঅরবিন্দ এগিয়ে চললেন । সম্মান-অপমানের কথাই নয় --- বসলেন ধ্যানে । তিনি চাইলেন মননকে ছাড়িয়ে চলে যেতে এক ঊর্ধ্ব , ঊর্ধ্বতর , ঊর্ধ্বতম রাজ্যে ঊর্ধ্বতর মানসের ( higher mind ) বিভাসিত চেতনার ( illumined mind ) স্তর ছাড়িয়ে অধিমানসের (Overmined) রাজ্য পেরিয়ে অতিমানসের (Super mined) জগতে । এই ঊর্ধ্বতমের আলো পরিস্ফুট হবে নিচের প্রতিটি চেতনায় রোমে রোমে । পরশমণির স্পর্শে সবকিছু হবে স্বর্ণময় ( golden light ) । Let us salute the Dawn --- আলো , আলো । স্তব্ধ ধ্যানের মধ্যে তিনি নিজের ভিতরের সত্তাকে অনুভব করেছিলেন , নিজের অন্তরকে দেখেছিলেন , পেয়েছিলেন এক বিশাল শান্তি , অটল স্থিতি । Silence is the birth place of Soul --- পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের জন্য , পশু-পাখি-কীটপতঙ্গের জন্য এমন করে তো আগে কোনদিন ভালোবাসা অনুভব করিনি ! ভগবান , তুমি আমাকে দীক্ষা দিয়েছ --- দিয়েছ প্রেমের দীক্ষা । এই নির্জন কারাগার আমার তপস্যার বেদী , আমার যোগাশ্রম । আমি স্পষ্ট অনুভব করি --- অন্তরে তুমি বলছো --- সনাতন ধর্মকে জাগ্রত করার মহান ব্রত তুমি আমাকে দিতে চাও । স্পষ্ট শুনি , স্বামী বিবেকানন্দের দৃপ্ত কন্ঠস্বর --- প্রত্যেক মানুষ পরিপূর্ণতার জন্য জেগে থাকবে ( A divine life in a Devine body ) । যা বড় তা-ই ধর্ম , যা বৃহৎ তা-ই আদর্শ , যা মহৎ তা-ই স্বপ্ন । বক্তৃতায় নয় , কূটনীতির কৌশলে নয় , রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে নয় , অর্থনীতির প্রাচুর্যে নয় --- এই সত্যে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে চাই নিষ্ঠা , প্রেম , ত্যাগ , সারাজীবনের সমগ্রতার সাধনা । কবিগুরুর অনুপম ভাষায় --- ' পীড়িত ভুবন লাগি মহাযোগী করুণাকাতর ' -- অরবিন্দকে গভীরভাবে আলোড়িত করেছিলেন রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ । এতো শান্তি , এত নীরবতা , এতো অটল স্থিরতা তো আগে কখনো পাইনি ! মনে হয় স্বয়ং বাসুদেব আমাকে কোলে করে রয়েছেন , তাঁরই শ্রীঅঙ্গের স্পর্শ অনুভব করছি । এই উঁচু পাঁচিল , এই লোহার গারদ , এই সাদা দেওয়াল , এই সূর্যরশ্মিদীপ্ত নীলপত্রশোভিত বৃক্ষ --- সব চিন্ময় , সবই চৈতন্যময় , সবই প্রেমময় । ওই যে জেলের যত হতভাগ্য কয়েদি , ওই যত সান্ত্রী , ওই ওঁরা সব-সব স্বয়ং বাসুদেব ! আমি তাঁর মোহন বাঁশির শব্দ শুনতে পাচ্ছি আর আমার জীবন , আমার হৃদয় তীব্রভাবে দুলছে । তাঁর বাঁশির ওই মোহন আকর্ষণে উপলব্ধি হচ্ছে --- " বাসুদেব সর্বং ইতি ..... " । " কারাকাহিনী " - তে তিনি লিখেছেন -- " এক বছরের কারাবাস । এই সময়ের জন্য মানুষের জীবনের যত বন্ধন ছিল সবই ছিন্ন হয়ে যায় ও মানুষকে সমাজের বাইরে পিঞ্জরাবদ্ধ পশুর মতো থাকতে হয় । তবে তিনি যখন এর পরে আবার নতুন করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করবেন তখন পুরাতন পরিচিত অরবিন্দ ঘোষের পরিবর্তে আলিপুরস্থ আশ্রম থেকে বের হবে এক নতুন অরবিন্দ --- নতুন চরিত্র , নতুন বুদ্ধি , নতুন প্রাণ , নতুন মন , নতুন কর্মভার গ্রহণ করে " । চিত্তরঞ্জন দাশ অনন্য দক্ষতা ও অমানুষিক পরিশ্রমে শ্রীঅরবিন্দকে কারামুক্ত করেন ।
জেল থেকে যখন বের হয়েছিলেন তখন শ্রীঅরবিন্দ ছিলেন একেবারেই অন্য একজন মানুষ । বিপ্লবের কথা তখন আর তিনি বলছেন না, বলছেন শুধু আধ্যাত্মিক কথা । প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে সরে এসে তিনি কলম ধরেছিলেন ' কর্মযোগীন ' আর ' ধর্ম ' পত্রিকার হয়ে । আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন --- " জেলে ধ্যানমগ্ন থাকার সময় আমি অবিরাম শুনতে পেতাম বিদেহী স্বামী বিবেকানন্দের বাণী । একা একটি কুঠুরিতে এক পক্ষকাল ধ্যানমগ্ন থাকার সময় স্বামী বিবেকানন্দ যেন রোজ আমার সঙ্গে কথা বলতেন " । একথা অনেকের কাছে অলীক মনে হলেও শ্রীঅরবিন্দের নিজের কথায় ---- ' Vivekananda came and gave me the knowledge of intuitive mentality . I had not the least Idea about it at that time ....... The contact lasted for about three weeks and then he withdrew ' । শ্রীরামকৃষ্ণদেব সম্পর্কে তাঁর উক্তি ---- ' For myself it was Ramakrishna who personally came and first turned me to this Yoga . Vivekananda in the Alipore jail gave me the foundation of that knowledge which is the basis of our Sadhana ' ।

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ যে অনন্য দক্ষতা ও অমানুষিক পরিশ্রমে শ্রীঅরবিন্দকে ফাঁসির মঞ্চ থেকে কারামুক্ত করেছিলেন তা ভারতের জাতীয় ইতিহাসে অম্লান হয়ে থাকবে চিরকাল । জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর নিজেকে তিনি সঁপে দিয়েছিলেন আধ্যাত্মিকতায় । প্রবল রাজনৈতিক ঘুর্ণিস্রোতের দিনগুলিতে অন্তরঙ্গ ও ঘনিষ্ঠজনেরা তাঁকে জেনেছিলেন " শুদ্ধ-আত্মা যোগীরূপে " । ব্যাখ্যা করে তিনি বলেছিলেন , " ভারত মহান হবে অর্থ ভারতের সনাতন ধর্ম মহান হবে , ভারতের সনাতন আদর্শ ( ধর্ম ) সারা বিশ্বে বিস্তার লাভ করবে " । কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তাঁকে নমস্কার জানিয়েছেন --- " স্বদেশ-আত্মার বাণীমূর্তিরূপে " । একদিন অরবিন্দ শুনলেন তাঁর অন্তরের ডাক আর পণ্ডিচেরী যাওয়ার সেই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন । ১৯১০ সালের ১ এপ্রিল নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মতোই বৃটিশ গোয়েন্দাদের দৃষ্টি এড়িয়ে তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন ফরাসি উপনিবেশ পন্ডিচেরীতে --- সে ছিল আর এক মহানিষ্ক্রমণের অবিশ্বাস্য সুদীর্ঘ কাহিনী । পন্ডিচেরীতেই বিপ্লবী অরবিন্দের রূপান্তর ঘটেছিল ঋষি অরবিন্দে । এখানে তিনি বেদ , উপনিষদ , ষড়দর্শন , গীতা , পুরাণ প্রভৃতি হিন্দুধর্মীয় বইগুলি থেকে প্রাচীন ভারতের ধর্ম ও দর্শনশাস্ত্রে গভীর জ্ঞান অর্জন করেছিলেন --- " সবকিছুই এক ব্রহ্ম থেকে সৃষ্ট আবার ব্রহ্মতেই লয় --- এ চক্র চিরন্তন , জীবন ও মৃত্যু একই চক্রের দুটি দিক --- এটি আত্মার পুনরুজ্জীবন , বিশ্বজগতের যা শাশ্বত নীতি তা-ই মানবাত্মা ও নিখিল প্রকৃতির পরিণাম নির্ধারণ করে , মানুষের লক্ষ্য হলো দিব্যজীবন যা ব্রহ্মে মিশে যায় , আত্মজ্ঞানের মাধ্যমেই মানুষ সেই দিব্যজীবনের সন্ধান পায় । এর জন্য ধর্মীয় অনুশাসন ও আচার অনুষ্ঠান নিষ্প্রয়োজন " । অধ্যাত্মভাবে পরিমণ্ডিত এমন এক আদর্শ সমাজের কথা তিনি ভেবেছিলেন যা সকলের জীবনকেই করে তুলবে সুন্দর ও সমৃদ্ধ । আধ্যাত্মিক প্রেরণাই হবে তার সঞ্চালক । মানুষকে শুধু অতিমানসিক গুণসমন্বিত একটি জাত বা গোষ্ঠী হয়ে উঠতে হবে । মানব-সমাজের যথার্থ বিকাশ ও অগ্রগতির জন্য মানব-প্রকৃতির এই পরিবর্তন হওয়াটা অত্যন্ত জরুরি । এই সময় তিনি ধর্ম , দর্শন ও ভারতীয় সংস্কৃতির উপর বহু গ্রন্থ রচনা করেছিলেন । " অতিমানস তত্ত্ব " তাঁর প্রধান অবদান । সচ্চিদানন্দের সঠিক জ্ঞান ও পূর্ণশক্তির উপলব্ধিকেই তিনি " অতিমানস " বুঝিয়েছেন অর্থাৎ মানসস্তর থেকে অতিমানস স্তরে উঠে চরম সত্য ব্রহ্মকে জানা । ২৯ মে , ১৯২৮ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ পন্ডিচেরীতে শ্রীঅরবিন্দের সঙ্গে প্রায় এক ঘন্টাকাল সময় একান্ত আলাপচারিতায় কাটিয়েছিলেন । ফিরে এসে কবিগুরু লিখেছিলেন ---- " প্রথম তপোবনে শকুন্তলার উদ্বোধন হয়েছিল যৌবনের অভিঘাতে প্রাণের চাঞ্চল্যে । দ্বিতীয় তপোবনে তাঁর বিকাশ হয়েছিল আত্মার শান্তিতে । অরবিন্দকে তাঁর যৌবনের মুখে ক্ষুব্ধ আন্দোলনের মধ্যে যে তপস্যার আসনে দেখেছিলুম সেখানে তাঁকে জানিয়েছি --- অরবিন্দ , রবীন্দ্রের লহো নমস্কার । আজ তাঁকে দেখলুম তাঁর দ্বিতীয় তপস্যার আসনে , অপ্রগল্ভ স্তব্ধতায় --- আজও তাঁকে মনে মনে বলে এলুম --- অরবিন্দ , রবীন্দ্রের লহো নমস্কার " । কয়েক বছর পরে দিলীপ কুমার রায়কে কবিগুরু লিখেছিলেন --- " শ্রীঅরবিন্দ আত্মসৃষ্টিতে নিবিষ্ট আছেন । তাঁর সম্বন্ধে সমাজের সাধারণ নিয়ম খাটবে না । তাঁকে সসম্ভ্রমে দূরেই স্থান দিতে হবে --- সব সৃষ্টিকর্তাই একলা , তিনিও তাই । তাঁর উপলব্ধির ক্ষেত্র সকল জনতাকে উত্তীর্ণ হয়ে । আমরা সেটাকে সহ্য করি কেন ? যেজন্য মেঘকে সহ্য করি দূর আকাশে জমতে --- শেষকালে বৃষ্টি পাওয়া যাবে চাষের জন্য তৃষার জন্য " ।
মানুষে মানুষে মিলিয়েই মহাদেবতা । তাঁকেই জীব বলি , শিব বলি , The Universal , The Eternal বলি , Cosmic Law বলি , চৈতন্য-পুরুষ বলি , মনের মানুষ বলি । তাঁরা আস্তিক্যবাদী কি নাস্তিক্যবাদী , তাঁরা যুগ যন্ত্রণায় বিশ্বাসী কি অবিশ্বাসী এসব কথা এহ বাহ্য , আমরা শুধু জানি দুঃখকষ্টের অতীত এক স্তরে আত্মোপলব্ধির মহিমায় সমাসীন যাঁরা , ত্যাগব্রতে দীক্ষিত যাঁরা , তাঁরাই নমস্য । কর্মী , জ্ঞানী , ধ্যানীর আসন সেখানে --- Everything can be done if God-touch is there । ভারতচেতনার এক অন্যতম মূর্তি শ্রীঅরবিন্দ এই শিক্ষাই দিয়েছেন --- কর্মে , জ্ঞানে , ভক্তিতে সেই পরমই পরিস্ফুট । তিনি বলেছেন --- এমন একটা সমাজচেতনার সূত্রপাত হয়েছিল , " ..... a society electric with thought and loaded to the brim with passion " । মন্দির গড়তে চেয়েছিলেন শ্রীঅরবিন্দ , তবে তা বাইরে নয় , সাহিত্যের মন্ত্রমুগ্ধ স্তরেও নয় , শুধুমাত্র অন্তরাত্মার পরম প্রকাশ রূপে ও পূর্ণ যোগের মাধ্যমে । সৃষ্টির পরিণাম এই চৈতন্যের মুক্তির অভিব্যক্তিতে --- মন মে হরি কা নাম , হাথমে দুনিয়া কা কাম , তবে মিলে পরমাত্মা রাম...... ।।।
লেখাটি কেমন লাগলো আপনার ? অবশ্যই Comment-এ জানানোর অনুরোধ রইল।
0 Comments
Post a Comment