মহাভারতের কল্পকাহিনীর নেপথ্যে

 মানুষের মহাকাব্য মহান গ্রন্থ মহাভারতের মধ্যে লৌকিক ও অলৌকিক , স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক নানান ধরনের কল্পকাহিনীর বিচিত্র এক সংমিশ্রণ লক্ষ্য করা যায় , যা পড়তে পড়তে মনে হয় আমরা যেন এক অদ্ভুত স্বপ্নদৃষ্ট লোকে উপস্থিত হয়েছি । সেই সমস্ত কল্পকাহিনীগুলির ভিতরে যেমন রয়েছে দেবতা ও মানুষের মধ্যে অবাধ মেলামেশা , তেমনি আছে মার্কণ্ডেয় ও ব‍্যাস প্রভৃতি অমর বা মৃত‍্যুহীন ঋষিদের হাজার হাজার বছরের তপস্যা , রয়েছে বিখ্যাত বীরযোদ্ধাদের ব‍্যবহৃত নানান ধরনের উন্নতমানের অলৌকিক যানবাহনের বর্ণনা ও সেইসঙ্গে রয়েছে উন্নতমানের যুদ্ধাস্ত্রগুলির গঠন ও প্রয়োগ কৌশল , আছে ধৃষ্টদ‍্যুম্ন ও দ্রৌপদীর মতো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের অলৌকিক জন্মবৃত্তান্ত । এছাড়াও রয়েছে দেবতা , যক্ষ , গন্ধর্ব , নাগ , কিন্নর প্রভৃতি নানান শ্রেণীর জনগোষ্ঠীর বর্ণনা , রয়েছে ঋষিদের দেওয়া নানান অভিশাপ অথবা বর --- যেগুলি অবশ্যম্ভাবী ও ইচ্ছা করলেই সেগুলি প্রত্যাহার করা যায় না , রয়েছে মানুষের জন্মের জন্য নারীগর্ভ অনাবশ্যক --- মাছের পেট , শরের ঝোপ বা কলসিতেও জরায়ুর কাজ সম্পন্ন হয় ইত্যাদি ইত্যাদি । এগুলির প্রত‍্যেকটিই অত্যন্ত বিস্ময়কর ও মানুষের বুদ্ধির অগম‍্য বা অগোচর , এক কথায় --- অলৌকিক ‌। মহাভারতের মূল বৃত্তান্তটি রচিত হয়েছে চন্দ্রবংশীয় দুই পরিবার পাণ্ডব এবং কৌরবদের গ‌হবিবাদ বা উত্তরাধিকারের মহাসংঘর্ষ ও তার পূর্বাপর ঘটনাবলীকে কেন্দ্র করে । এখানে পাণ্ডব পক্ষ ও কৌরব পক্ষ যথাক্রমে ধর্ম ও অধর্মের পক্ষ । ভগবান শ্রীকৃষ্ণ রয়েছেন এই ধর্মের পক্ষে । তিনি তখনকার যাবতীয় রাজশক্তিকে পদানত করে নিজের অভিমত ধর্মপ্রাণা-রাজশক্তিরই অভ্যুদয় সাধন করেছেন এবং গীতোক্ত স্ববাক্য প্রতিপালন করেছেন --- " যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত , অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্ । পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্ , ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে " । অর্থাৎ যখনই ধর্মের গ্লানি ও অধর্মের অভ্যুত্থান হয় , তখনই আমি অবতীর্ণ হই সাধুদের পরিত্রাণ , অসুরদের বিনাশ এবং ধর্মের জয় সাধন করতে । তাই মহাভারতের মূল বাণী হলো --- ধর্মের জয় আর অধর্মের বিনাশ । পাণ্ডবরা ন্যায় , কর্তব্য ও ধর্মের পক্ষ আর কৌরবেরা আন্যায় , জোর-জবরদস্তি ও অধর্মের পক্ষ । স্বাভাবিক মানব-চরিত্রের ঘাত-প্রতিঘাত , নাটকীয় ঘটনাসংস্থান , সরলতা ও চক্রান্ত , করুণা ও নিষ্ঠুরতা , ক্ষমা ও প্রতিহিংসা , মহত্ত্ব ও নীচতা , নিষ্কাম কর্ম ও ভোগের আকাঙ্ক্ষা সবই মহাভারতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে । এর বাইরেও রয়েছে আদর্শ ও ন্যায়-অন্যায়ের বিচারপদ্ধতি ।   যেমন মহামতি দ্রোণাচার্য একলব্যকে তার আঙুল কেটে দক্ষিণা দিতে বলায় অর্জুন খুশি হয়েছিলেন । আবার জতুগৃহ থেকে পালাবার সময় পাণ্ডবরা বিনা দ্বিধায় এক নিষাদী ও তার পাঁচ পুত্রকে পুড়ে মরতে দিয়েছিলেন । আবার দুঃশাসন যখন চুল ধরে দ্রৌপদীকে দ্যূতসভায় টেনে এনেছিল , তখন ভীষ্ম , দ্রোণ ও বিদুর ও রাজা ধৃতরাষ্ট্রের মতো মহামতি মানুষেরা দ্রৌপদীর করা প্রশ্নের কোন সঠিক উত্তর দিতে পারেননি অথচ যুদ্ধকালে তাঁরা বহু নিকট আত্মীয় ও বন্ধুবান্ধবদের অসংকোচে বধ করেছেন --- এসব প্রশ্নের বিশদ উত্তর মহাভারতে পাওয়া যায় না ।

    মহাভারতের আদিপর্বে দেখা যায় , মন্ত্রীরা রাজা জনমেজয়কে বলছেন , ' হে পুরুষশ্রেষ্ঠ আপনি কুলক্রমাগত এই কুরুরাজ্যকে সহস্রবছর যাবৎ প্রতিপালন করে আসছেন ..... ' ইত্যাদি । আবার বনপর্বে , ঋষি মার্কণ্ডেয় মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে বলেছেন " হে রাজসত্তম ! জগতের আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত যা কিছুই ঘটে সে সমস্তই আশ্চর্য " । মহাভারত থেকেই জানা যায় , মানুষের ৪৩২ বছরে দেবতাদের ১ বছর । এই হিসাব অনুযায়ী ১৭২৮০০০ বছর ধরে সত‍্যযুগের ব‍্যাপ্তি , ১২৯৬০০০ বছর ত্রেতা , ৮৬৪০০০ বছর দ্বাপর আর ৪৩২০০০ বছর কলিযুগের ব্যাপ্তি । মার্কণ্ডেয় মুনির কাছে মাৎস‍্যক কাহিনী শোনার পর যুধিষ্ঠির তাঁকে বলেছিলেন --- " আপনি অনেক যুগ দেখেছেন " ! এর অর্থ দ্বাপরে যুধিষ্ঠির এই কাহিনী শুনেছেন ধরে নিলে মার্কণ্ডেয় মুনির বয়স দাঁড়াবে ৩৮৮৮০০০ বছর ! কোন লৌকিক বুদ্ধি এর ব‍্যাখ‍্যা করতে পারে না । তবে এটুকু নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে , জাগতিক সংখ‍্যার হিসাবে নয় , মার্কণ্ডেয় মুনি চিরজীবী হয়েছেন শুধুমাত্র কবির মানসিক ধ‍্যানে । শুধু তাই নয় , ব্যাসদেবকেও কোন একজন মানুষ হিসাবে নয় , বহুকাল ধরে সম্পাদনা করে আসা এক গোষ্ঠী হিসাবে ধরা হয় বলেই মনে হয় । কথায় বলে , মানুষ মৃত্যুহীন বা অমর হন তাঁর চিরস্মরণীয় কীর্তির দ্বারা , লোকে চিরদিন যাঁর গুণকীর্তন করে । কাজেই মহাভারতে উল্লেখিত বেশ কিছু সংখ্যা বুদ্ধিগ্রাহ্য হলেও অধিকাংশই বাহুল্যদোষে দূষ্ট । যাইহোক , এই মহাযুদ্ধের সময়কাল মোটামুটি ভাবে বলা যায় ৩০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি ।

  এই মহাকাব্যে স্বর্গ , মর্ত ও পাতাল নামক ত্রিলোকের কথা বলা আছে । কোথায় সেগুলির অবস্থান ? উল্লিখিত ত্রিলোকের মধ্যে স্বর্গ এবং  পাতালের মাঝখানে থাকা মানুষের বাসভূমি ও বিচরণভূমি " মর্তলোকের " অবস্থানটিকে স্পষ্টভাবে বোঝা গেলেও মানুষের চেয়ে মহৎ ও উন্নত দেবতাদের বিচরণ ক্ষেত্র " স্বর্গলোক " বা মানুষের চেয়ে নিকৃষ্ট "  দৈত্য-রাক্ষসদের বাসভূমি " পাতালের " অবস্থানটি প্রহেলিকার মতো মানুষের বুদ্ধি ও ব‍্যাখ‍্যাকে আচ্ছন্ন করে রাখে । অনুমান করা যায় , মহাভারতকার বেদব‍্যাস বা তাঁদের উত্তরসুরি বৈদিক ঋষিদের রচিত পরমেশ্বর ভগবান ( ঈশ্বর ) প্রাথমিকভাবে প্রকৃতিনির্ভর ও সামগ্রিকভাবে ধ‍্যাননির্ভর কোন সত্তা ছিলেন , যিনি ভগ্  অর্থাৎ ঐশ্বর্য-জ্ঞান-বীর্য-যশ-সৌভাগ্য-বৈরাগ্য -- এই ষড়গুণের অধিকারী , অসীম ক্ষমতাবান ও সকলেরই শরণ‍্য ছিলেন । বিপদে-আপদে তাই সাধারণ দেবতারাও  এই ঈশ্বরেরই শরণাপন্ন হয়ে থাকতেন । ব্রহ্মা , বিষ্ণু ও মহেশ্বর একত্রে মিলে হয়েছিলেন এই পরমেশ্বর ভগবান । পরবর্তীকালে পৌত্তলিক ভাবনায় জর্জরিত আর্য ঋষিরা নিজেদের চেহারার আদলে দেবতাদের নানান রূপ ও মূর্তি কল্পনা করেছিলেন । প্রমাণ হিসাবে কোন কিছু দেখানো না গেলেও মহাভারতের প্রচ্ছন্ন সমর্থন নিয়ে বলতে পারা যায় যে , ভারতের উত্তর হিমালয় অংশে আর্যদের চেয়েও অনেক বেশি উন্নত ও শক্তিশালী এক শ্রেণির জাতি বাস করতেন যাঁদেরই দেবতা বলা হয়ে থাকতে পারে আর তাঁদেরই বাসভূমি এই উত্তর হিমালয় অঞ্চলকে " স্বর্গলোক " ধরে নিয়ে মহেশ্বর শিবের বাসভূমি " কৈলাসের " অবস্থানটি কল্পনা করা হয়ে থাকে । মহাপ্রস্থানিক পর্বে যুধিষ্ঠিরদের এই হিমালয়ের পথে সশরীরে স্বর্গ গমন খানিকটা হলেও এই সত‍্যটিকেই  প্রমাণ করে । উল্টোদিকে ভারতের দক্ষিণে সমুদ্র সংলগ্ন বিশাল বনভূমি ও সিংহলের মতো দ্বীপগুলোকে নিয়ে দৈত্য-রাক্ষসদের বাসভূমি " পাতাল " বলে ধরা হয়ে থাকে । কারণ মাটির নিচে ভূগর্ভ ( পাতাল ) তো কখনও মানুষের বাসযোগ্য হতে পারে না । সম্ভবত এই কারণেই ভারতের আর্যদের অগম্য উত্তর হিমালয় সংলগ্ন অঞ্চলকে দেবতাদের বাসভূমি " স্বর্গ " এবং ভারতের দক্ষিণে সাগর তীরবর্তী বনভূমি ও দ্বীপ সংলগ্ন অঞ্চলকে রাক্ষসদের বাসভূমি " পাতাল " ধরে নিয়ে ভারতের মাঝখানের অঞ্চলটিকে " মর্তলোক " হিসাবে ধরা হয় । তবে পণ্ডিতদের অনুমান , আর্য ঋষিরা পুজো-অর্চনা , সাধন-ভজন , যাগযজ্ঞ ইত্যাদি নিয়ে থাকতেন আর যারা সেই সব যাগযজ্ঞ , পুজো-অর্চনা পছন্দ করত না বা সেই  যাগযজ্ঞ পণ্ড করে দিত বা পণ্ড করে দেওয়ার চেষ্টা করত তাদেরই রাক্ষস বলে গণ্য করা হত । এ-থেকেই বোঝা যায় যে , ভারতে আসার পর ভূমির অধিকার ,  খাদ্যের অধিকার ও সংস্কৃতির পার্থক্য ইত্যাদি নিয়ে যাদের সঙ্গে আর্যদের লড়াই হয়েছিল বা যারা আর্যসংস্কৃতিতে আঘাত হেনেছিল তারাই আর্যভাষায় রাক্ষস বা দৈত্য হিসাবে গণ্য । একইরকমভাবে মহাভারতে অলৌকিক কল্পনায় ধরে নেওয়া যায় যে , তখনকার ভারতের পটভূমিতে দেবতা ও নানান জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও কাজের ধরন অনুযায়ী তাদেরকে যক্ষ , গন্ধর্ব , নাগ , কিন্নর , অপ্সরা ইত্যাদি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে বলে মনে করা যেতে পারে ।  মহর্ষি ব‍্যাসদেব তাঁর মহাকাব‍্যে নানান অলৌকিক ঘটনার ভিতর দিয়ে এই সব বিচিত্র জনগোষ্ঠীর রূপান্তর ঘটিয়েছেন বলে ধরে নেওয়া যায় ।

          মহাভারতের কাহিনী অনুসারে বলা যায় , ধৃষ্টদ‍্যুম্ন ও দ্রৌপদীর জন্ম হয়েছিল যজ্ঞের আগুন থেকে , দ্রোণাচার্য জন্মেছিলেন কলসির মধ্যে , সত‍্যবতী জন্মেছিলেন মাছের পেটে আবার কৃপ ও কৃপী জন্মেছিলেন শর-বনে , এছাড়াও পাণ্ডব বা গান্ধারীর শতপুত্রলাভের জন্মকাহিনী বা কর্ণের জন্মের আগে কুমারী কুন্তীর ঋষি দুর্বাসার কাছে দেবতা আহ্বানের মহামন্ত্র লাভ , এমনকি কার্তিক ও অশ্বিনীকুমারের জন্মবৃত্তান্ত ইত্যাদি নানান অলৌকিক কাহিনী দিয়ে মোড়া । কারণ , আগুনের লেলিহান শিখা থেকে প্রাণের সৃষ্টি বা জরায়ুর অনুপস্থিতিতে নতুন প্রাণের সৃষ্টি কোন বিজ্ঞানবুদ্ধি অনুমোদন করে না । মহাভারতে তাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার অধিকারী এই সব নায়ক বা নায়িকাদের অবৈজ্ঞানিক ও অলৌকিক জন্মকাহিনীর ঘটনাগুলিকে মহাকাব‍্যের প্রেক্ষিতে স্মরণীয় , বিশিষ্ট ও আকর্ষণীয় করে রাখবার উদ্দেশ‍্য নিয়েই সম্ভবত মহাভারত রচয়িতা এগুলিকে লৌকিক রাখা সমীচীন বলে মনে করেননি আর তাই নানান কল্পকাহিনীর ভেতর দিয়ে তিনি এই সব জন্মবৃত্তান্তগুলিকে দৈবী বা অলৌকিক আবরণে মুড়ে দিয়েছিলেন বলে ধরে নেওয়া যায় ।

      আবার , দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের মতো একটি লৌকিক লজ্জাকর ঘটনার অলৌকিক সমাধানের কল্পকাহিনীও দেখতে পাওয়া যায় মহাভারতের সভাপর্বে । একজন সম্ভ্রান্ত রজস্বলা একবস্ত্রা নারী প্রকাশ‍্য রাজসভায় স্বামী-শশুর নির্বিশেষে অগণিত পুরুষের সামনে বিবস্ত্রা হতে চলেছিলেন --- এই রকম একটি লজ্জাকর ঘটনার অলৌকিক সমাধানের পথ খোঁজার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল ভারতীয় শিল্প ও সম্ভ্রমবোধের স্বার্থেই । দ্রৌপদী , দুঃশাসন এবং শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন এই লজ্জাকর ঘটনাটির মূল তিনটি চরিত্র । শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন মায়াবী , তিনি যোদ্ধা , তিনি রাজনীতিজ্ঞ , তিনি ঈশ্বর , তিনি মহাভারতের কেন্দ্রীয় চরিত্র ও দ্রৌপদীর সখা । তাই তাঁর মাধ্যমেই অলৌকিক উপায়ে অফুরন্ত বস্ত্ররাশির যোগান দিয়ে অধর্মের পরাজয় ও ধর্মের জয় ঘোষণা করা হয়েছিল । আসলে ঘটনাটি এতটাই নক্কারজনক বলে মনে হয়েছিল কাব‍্য রচয়িতার যে তিনি নিজেই এক দৈবী ও অলৌকিক শক্তিকে ব‍্যবহার করে ঘটনাটির একটা সুষমামণ্ডিত পরিণতির মর্যাদা দিয়েছিলেন , যদিও এর একটি লৌকিক প্রতিবাদ ঘটানো হয়েছিল বিকর্ণকে দিয়ে ।

      মহাভারতের আর একটি অন‍্যতম অলৌকিক  বিষয় হল ---  মুনি-ঋষিদের বর এবং অভিশাপ । মহাভারতে সেগুলির প্রয়োগ ও সাফল্য এমনই ত্বারিত ও অমোঘ যে মানুষের বুদ্ধি-যুক্তিকে দূরে সরিয়ে রাখতে হয় । এ-ধরনের বর এবং অভিশাপের অসংখ্য উদাহরণের মধ্যে কয়েকটি হলো --- মহামতি ভীষ্মকে শান্তনুর ইচ্ছামৃত্যু বর প্রদান , কুমারী কুন্তীকে দুর্বাসার মহামন্ত্র বর প্রদান , কর্ণকে পরশুরামের অস্ত্র বিস্মৃতির অভিশাপ দান , শ্রীকৃষ্ণকে গান্ধারীর জ্ঞাতি-বিলুপ্তির শাপ ইত্যাদি ইত্যাদি । তবে , অভিশাপের কারণেই হোক বা অন্য যে কোন কারণেই হোক যদুবংশ সত্যিই সত্যিই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল , শ্রীকৃষ্ণের রাজ‍্য দ্বারকা নগরী সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে গিয়েছিল । মহাভারতে এই সব বর বা অভিশাপগুলির প্রয়োগ এমনভাবে করা হয়েছে যে পড়তে পড়তে মনে হয় আমরা যেন একটা অদ্ভুত স্বপ্নদৃষ্টলোকে উপস্থিত হয়েছি । কীভাবে একজন মানুষ তিনি দেবতাই হোন বা একজন ঋষিই হোন তাঁর প্রসন্নতার কারণে তিনি অন্য একজনকে যা বলছেন অর্থাৎ বর দিচ্ছেন বা ক্রুদ্ধ হয়ে যা বলছেন অর্থাৎ অভিশাপ দিচ্ছেন সেগুলি প্রদত্ত মানুষের জীবনে অমোঘ ভাবে ফলে যাচ্ছে । লৌকিক জীবনে আমরা দেখি , কোন মানুষের কাজ বা আচরণে প্রসন্ন হয়ে অন্য কোন মানুষ তার কল‍্যাণ কামনা করছেন অর্থাৎ আশীর্বাদ করছেন বা ঈশ্বরের কাছে তার মঙ্গল কামনা করছেন আর এই আশীর্বাদ বা কল‍্যাণকামনা বা শুভকামনা যে ফলবতী হবেই তার তো কোন নিশ্চয়তা নেই । এগুলো শুধুমাত্র মানুষের মনের সদ্ভাবনার পরিচায়ক । অন‍্যদিকে , অভিশাপগুলোও বলা যায় এক ধরনের লৌকিক গালাগালি বা মনের ঝাল মেটানো ছাড়া আর কিছু নয় । কিন্তু মহাভারত অনুযায়ী এই সব বর বা অভিশাপগুলি অমোঘ , অবশ‍্যম্ভাবী ও অপ্রত‍্যাহারযোগ‍্য । সহজ কথায় , মহাভারতীয় বর বা অভিশাপগুলি লৌকিক ইচ্ছার অলৌকিক সফলতা ।

        মহাভারতের বিখ্যাত যোদ্ধা --- ভীষ্ম , দ্রোণাচার্য , অর্জুন , কর্ণের ব‍্যবহৃত ব্রহ্মাস্ত্র , নারায়ণ অস্ত্র , ব্রহ্মশির ইত্যাদি অস্ত্রগুলির গঠন , প্রয়োগ , পরিচয় কিংবা কুবেরের কামগামী বিমান বা ইন্দ্রের মাতলি চালিত বিমান ইত্যাদি বাহনবৃত্তান্ত আমাদের বুদ্ধির অগোচরেই থেকে যায় । অলৌকিকত্বই এগুলির একমাত্র পরিচয় । বর্তমান যুগে বিমান অলৌকিক নয় তবে মহাভারতের সময়কার ইতিহাস কিন্তু বর্তমান বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির মতো এতটা উন্নতির অনুকূল ছিল না অথচ মহাভারতে  এই সব যুদ্ধাস্ত্র ও বিমানকে সাদরে বরণ করে নেওয়া হয়েছে । এ-প্রসঙ্গে রাজশেখর বসু মন্তব্য করেছেন -- মহাভারতের বীর যোদ্ধাদের অস্ত্রের কাছে আধুনিক অস্ত্রও অতি তুচ্ছ ! তাই বলা যায় , এগুলোও মানুষের কল্পনার জয়গান ! মানুষের মনের মতো সর্বত্রগামী !

          মহাভারত অনেক রকমভাবেই পড়া যায় --- গল্প হিসাবে , উপন্যাস হিসাবে বা ধর্মগ্রন্থ হিসাবে । কিন্তু  বিশ্লেষণধর্মী মনোভাব নিয়ে যদি মহাভারত পড়া যায় তাহলে বোঝা যাবে , আপাতদৃষ্টিতে অলৌকিক ঘটনাগুলির প্রকৃত ব‍্যাখ‍্যা কিন্তু এই মহাভারত থেকেই খুঁজে পাওয়া যায় এবং এইসব প্রকৃত ব‍্যাখ‍্যাগুলি লুকানো রয়েছে অন্য কোন ঘটনার মধ্যে অত্যন্ত সংক্ষিপ্তভাবে ও রূপক আকারে । ফলে সেগুলি সহজেই মানুষের নজর এড়িয়ে যায় । তবে প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রেই অলৌকিক ঘটনাগুলির প্রকৃত ব‍্যাখ‍্যা লেখা হয়েছে ঘটনাগুলি ঘটে যাওয়ার পর পরবর্তী পর্যায়গুলিতে । তাইতো মহান গ্রন্থ মহাভারতকে মনে হয় স্বপ্ন জগতের কোনও কল্পকাহিনী !   ,,,,,,,,,,,,,, ।।।

দিব্যেন্দুশেখর জানা, প্রাক্তন শিক্ষক


লেখাটি কেমন লাগলো আপনার ? অবশ্যই Comment-এ জানানোর অনুরোধ রইল।




Post a Comment

0 Comments

Contact Form