পরিযায়ী | প্রত্যয় গুপ্ত

পরিযায়ী
প্রত্যয় গুপ্ত ( উচ্চমাধ্যমিক ২০১৩)

পরিযায়ী পাখিদের দল সার বেঁধে দাঁড়িয়ে, মেখে নিচ্ছে পড়ন্ত বেলার সূর্যের লালিমা। বিকেলের সূর্য জলের আয়নায় প্রতিবিম্বিত হয়ে সৃষ্টি করছে কোনো এক নাম না জানা সুরের মনোহরি মূর্ছনা। Shelley-র কলম ধার করে প্রকৃতি যেন নিজেই নিজের রূপচর্চায় মন দিয়েছে। মিহি কুয়াশার চাঁদর যে আসতে আসতে নেমে আসছে সকলকে জড়িয়ে নিতে শীতের আস্তরণে, তা অনুভূত হচ্ছে প্রতি পলে।

পিকলু বাবার কাঁধে উঠে ঝিলের যেসব পাখি দেখছে, মুগ্ধতায় মোবাইল ক্যামেরায় বন্দি হচ্ছে তাদের কেউ কেউ। এক অনাবিল আনন্দ সাগরে সে যেন ভেসে চলেছে আজ সারাদিন। এমনিতে, নাগেরবাজারের যে অঞ্চলে তার বাড়ি সেখানে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কাকপক্ষী সংখ্যাগরিষ্ট, বাকি পাখিদের সাথে তার আলাপ তাই একেবারেই কম, সেখান থেকে এক্কেবারে বিদেশি পাখি দেখতে পাওয়ার সৌভাগ্যে সাতরাগাছির এই ঝিলকে তার প্রায় স্বর্গোদ্যানই মনে হচ্ছে। তার সাথে গঙ্গাবক্ষে লঞ্চের ফুরফুরে হাওয়া ও লাঞ্চে বিরিয়ানীর স্বাদ এখনো তার শরীরকে মোহাবিষ্ট করে রেখেছে। ছুটির দিনের এরকম সদ্ব্যবহার যে হতে পারে, এ ছিল তার ধারণারও বাইরে।

গত সপ্তাহে আত্রেয় ফ্যামিলির সাথে ইকো পার্ক ঘুরে এসে কৌশিক স্যারের ইংলিশ ক্লাসে বেশ জমিয়ে সেই গল্প করেছিল, স্যার ও মাঝে মাঝে সেই নিয়ে গল্প বলছিলেন। কাল কৌশিক স্যারের ক্লাস নেই, টিফিনের আগের ক্লাসটা পল্লব বাবুর। স্যার পড়ানো শেষ হয়ে যখন সবার সঙ্গে একটু গল্প করেন, তখন পিকলু ভেবে রেখেছে তার গল্প শোনাবে। আর যদি সময় নাও পায় টিফিনের পরের ক্লাস টাই সুব্রত বাবুর। স্যারের কাছে আবৃত্তি শোনা এমনিই পিকলুর খুব পছন্দের, তাই সে ভেবে রেখেছে স্যারকেও সে নিজের গল্প শোনাবে। সমস্যা একটাই, টিফিনে কথা আছে সবাই প্র্যাক্টিস করবে কলেজ মাঠে, শনিবার ছুটির পর কিশোর ভারতীর সঙ্গে ম্যাচ আছে। যদিও এই ম্যাচে ওরা আগে কখনো হারেনি। তবুও প্রেস্টিজ ফাইট যখন, প্র্যাক্টিস তো করতেই হবে।

সজোরে একটা ধাক্কা খেয়ে ধরমরিয়ে উঠলো পিকলু। দেখলো মা বলছে, "৯টা থেকে অনলাইনে ক্লাস। এখনো মরার মতো ঘুমোচ্ছে ছেলেটা। চল ওঠ। জলদি ফ্রেশ হয়ে খাবার টা খেয়ে নে।" ব্যাজার মুখে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো পিকলু। বেশ কিছুদিন হলো সে স্কুলে যায়নি। মহামারীর প্রকোপে স্কুল সেই যে বন্ধ হলো, পিকলু মিস করা শুরু করলো দিনের সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্তগুলোকে। তার বন্ধুদের, তার স্কুলকে, এবং একসঙ্গে মিলে হুল্লোড় করার সময় গুলোকে। ব্রাশ হাতে আধ-বোজা চোখে ঢুলতে ঢুলতে বসবার ঘরে গিয়ে দেখলো খবরের চ্যানেল চলছে।

টিভিতে সঞ্চালক খবর বলছে: "পরিযায়ী শ্রমিকেরা দল বেঁধে বিভিন্ন রাজ্যের জাতীয় সড়ক ধরে হেঁটে চলেছে নিজের নিজের বাড়ির পথে। অনাহারে ক্লিষ্ট শরীর তাঁদের নুয়ে পড়েছে, তবুও তাঁরা হাঁটছে, হাঁটছেই। ঠিক যেন Ginsberg-এর September on Jessore Road এর মতোই মর্মান্তিক তার দৃশ্যপট। কাঁধে তাদের একরত্তি সন্তানদের তুলে ক্রোশ-মাইলের দূরত্ব নিমেষে ঘুচিয়ে তুলছে লাখে লাখে শ্রমিক।"

পিকলু বুঝতে পারলো, স্বপ্ন সত্যিই খুব সুন্দর!



Post a Comment

1 Comments

  1. হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া গল্প।
    মানস কুমার সেনগুপ্ত, প্রাক্তনী, ১৯৭১.

    ReplyDelete

Post a Comment

Contact Form